দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয় গত বছরের ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে এ রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দুটি ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আরেকটি ট্রেন চলছে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয় গত বছরের ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে এ রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দুটি ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আরেকটি ট্রেন চলছে। এর বাইরে ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করছে রেলওয়ে। সব মিলিয়ে কক্সবাজারে ট্রেন চালিয়ে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি টাকা আয় করেছে সংস্থাটি। বিপরীতে ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। লাভের পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এ তথ্য পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বাণিজ্যিক ও মার্কেটিং বিভাগের।
» ১০ মাসে তিনটি নিয়মিত ও উৎসবে বিশেষ ট্রেন চালিয়ে আয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা
» বছরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ৪২০ কোটি টাকার সমপরিমাণ, সামনে আরো বাড়বে
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে নির্মাণ করা হয়েছে ১০১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়েছে ঋণের কিস্তি পরিশোধ। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও এডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৪২০ কোটি টাকার সমপরিমাণ) হারে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২৮ সালে এ কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ডলার। ঋণের কিস্তির সঙ্গে সুদ আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হবে। সুদের পরিমাণ প্রায় ২ শতাংশ। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০৪৮ সাল পর্যন্ত।
২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। রামু-ঘুনধুম অংশসহ প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। পরে রামু-ঘুনধুম অংশ স্থগিত রেখে নির্মাণ ব্যয় ১২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের মধ্যে তৈরি হওয়া নতুন রেলপথ দিয়ে ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দুটি আন্তঃনগর ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন পরিচালনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেলওয়ের বাণিজ্যিক ও মার্কেটিং বিভাগের তথ্য বলছে, চালুর পর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পর্যটক এক্সপ্রেস থেকে আয় হয়েছে ২৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন থেকে আয় হয়েছে ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন সময় বিশেষ ট্রেন চালিয়ে আরো কিছু অর্থ আয় করে রেলওয়ে। সব মিলিয়ে আয়ের পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি টাকা।
আয়ের বিপরীতে ট্রেনগুলোর পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারেননি রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তবে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রেন পরিচালনা করতে রেলের পরিচালন খরচ প্রায় ৫ লাখ টাকা। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে প্রতিটি ট্রিপে আয় হয় গড়ে ৭-৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ট্রিপেই রেলের পরিচালন মুনাফার পরিমাণ ২-৩ লাখ টাকা। প্রতি ট্রিপে ৩ লাখ টাকা পরিচালন মুনাফার হিসাবে কক্সবাজার রুটের তিনটি ট্রেন ও অন্যান্য ট্রেন থেকে রেলওয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে মুনাফা করেছে ২৫-২৬ কোটি টাকা।
ঢাকা-কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজারকে সবচেয়ে লাভজনক রুট হিসেবে উল্লেখ করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কক্সবাজারগামী ট্রেনে যাত্রী চাহিদা দেশের যেকোনো রুটের চেয়ে বেশি। বাড়তি ভাড়া দিয়ে হলেও মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করতে চায়। চালু হওয়ার পর মাত্র কয়েকটি ট্রেন পরিচালনা করে রেলওয়ে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয় করেছে কক্সবাজারের ট্রেনগুলো থেকে। আমরা এ রুটটি নিয়ে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। আগামী বছরের শুরুতে নতুন টাইম টেবিলে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ট্রেন যাত্রীরা আগের চেয়ে বেশি কক্সবাজারে ট্রেনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।’
রেলের কর্মকর্তাদের হিসাবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ লাভজনক রুটে পরিণত হয়েছে। তবে রেলপথটিতে ট্রেন পরিচালনা করে যে পরিমাণ মুনাফা সংস্থাটি করতে পারছে, তা ঋণের কিস্তির তুলনায় নগণ্য। রেলপথটি নির্মাণে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে এডিবি। মোট তিন ধাপে ঋণের অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে এডিবি প্রথম ধাপে ঋণ দিয়েছে ৩০ কোটি ডলার। ২০১৭ সালের ২১ জুন এডিবি ও ইআরডির মধ্যে হওয়া ঋণচুক্তি অনুযায়ী, পাঁচ বছরের রেয়াতকাল শেষে প্রথম ধাপের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে ২০২২ সাল থেকে। কিস্তি হিসাবে বছরে পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সঙ্গে ২ শতাংশ সুদ আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ঋণ পরিশোধ শেষ হবে ২০৪১ সালে।
দ্বিতীয় ধাপে এডিবি ঋণ দিয়েছে ৪০ কোটি ডলার (৩৫ কোটি ১১ লাখ ইউরো)। ২০১৯ সালের ২৩ মে এডিবি ও ইআরডির মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০২৪) সেপ্টেম্বর থেকে দ্বিতীয় ধাপের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ ২ কোটি ডলার। সুদ আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শেষ হবে ২০৪৪ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ মিলিয়ে বর্তমানে বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার (২০২৪ থেকে ২০৪৪ সাল পর্যন্ত)।
২০২৩ সালের ২৫ জুন তৃতীয় ধাপের ঋণচুক্তি করে এডিবি ও ইআরডি। ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি ডলার (৩৬ কোটি ৮৩ লাখ ইউরো)। ২০২৮ সালে শুরু হবে কিস্তি পরিশোধ। বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ডলার। তৃতীয় ধাপেও সুদ আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হবে। তৃতীয় ধাপে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শেষ হবে ২০৪৮ সালে। তৃতীয় ধাপের কিস্তি দেয়ার সময় হলে বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে বর্তমানে দিনে তিন জোড়া ট্রেন চলাচল করছে। যদিও এ রেলপথটিতে প্রতিদিন ২৩ জোড়া ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা রয়েছে। এ রেলপথের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করলেও নির্ধারিত সময়ে আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কক্সবাজার রেল বাংলাদেশের একটি বড় প্রকল্প। সাধারণত এ ধরনের প্রকল্পে অর্থনৈতিক রিটার্ন শুধু ট্রেন পরিচালনার আয় দিয়ে ধরা হয় না। কক্সবাজার রেল প্রকল্পটি দেশের পর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। পর্যটন ছাড়াও স্থানীয় অর্থনীতিতেও নিশ্চয় প্রকল্পটি ভূমিকা রাখবে। রেলপথটিতে সক্ষমতা অনুযায়ী ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হলে আয় আরো বাড়বে। সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ আয় ও পরোক্ষ সব সুফল যদি আমরা বিবেচনা করি, তারপরও প্রকল্পটি লাভজনক হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা দেখেছি, অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে যে পরিমাণ লাভ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে তা হচ্ছে না। আমরা কিছু প্রকল্পে দেখেছি, কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। কক্সবাজার রেল প্রকল্পেও এমনটি ঘটেছে। এ প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলে প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুফল অনেক দুর্বল হয়ে যায়। আমাদের দেশে অনেক সময় ঠিকভাবে সমীক্ষা না করে প্রকল্প নেয়ার ফলে সুফল পাওয়া যায় না। ফলে প্রকল্পের জন্য গ্রহণ করা ঋণের দায়ভার দেশের ওপর বড় চাপ তৈরি করে। সুত্র, বণিক বার্তা
পাঠকের মতামত